তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে
টুকরো ক'রে কাছি
ডুবতে রাজি আছি
আমি ডুবতে রাজি আছি।
সকাল আমার গেল মিছে,
বিকেল যে যায় তারি পিছে;
রেখো না আর, বেঁধো না আর
কূলের কাছাকাছি।
মাঝির লাগি আছি জাগি
সকল রাত্রিবেলা,
ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে
করে কেবল খেলা।
ঝড়কে আমি করব মিতে,
ডরব না তার ভ্রূকুটিতে;
দাও ছেড়ে দাও ওগো, আমি
তুফান পেলে বাঁচি।
.
শান্তিনিকেতন, ১৭ ভাদ্র-বিকাল, ১৩২১
29 November, 2015
তোমার খোলা হাওয়া
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো
ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো-- তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো-- তোমার
চরণমঞ্জীরে॥
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি-- তোমার
প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥
মনে ক'রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী-- তোমার
কনককঙ্কণে॥
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো-- তোমার
অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো-- তোমার
ললাটচন্দনে।
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো-- তোমার
অঙ্গসৌরভে।
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো-- তোমার
অতুল গৌরবে॥
.
রাগ: কীর্তন
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ৮ আশ্বিন, ১৩০৪
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1897
রচনাস্থান: সাজাদপুর
স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
27 November, 2015
নিরুদ্দেশ যাত্রা - আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী
নিরুদ্দেশ যাত্রা
-
আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী?
বলো কোন্ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী।
যখনি শুধাই, ওগো বিদেশিনী,
তুমি হাস শুধু, মধুরহাসিনী--
বুঝিতে না পারি, কী জানি কী আছে
তোমার মনে।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি,
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন
গগনকোণে।
কী আছে হোথায়-- চলেছি কিসের
অম্বেষণে?
বলো দেখি মোরে, শুধাই তোমায়
অপরিচিতা--
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে
দিনের চিতা,
ঝলিতেছে জল তরল অনল,
গলিয়া পড়িছে অম্বরতল,
দিক্বধূ যেন ছলছল-আঁখি
অশ্রুজলে,
হোথায় কি আছে আলয় তোমার
ঊর্মিমুখর সাগরের পার,
মেঘচুম্বিত অস্তগিরির
চরণতলে?
তুমি হাস শুধু মুখপানে চেয়ে
কথা না ব'লে।
হু হুক'রে বায়ু ফেলিছে সতত
দীর্ঘশ্বাস।
অন্ধ আবেগে করে গর্জন
জলোচ্ছ্বাস।
সংশয়ময় ঘননীল নীর,
কোনো দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর,
অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া
দুলিছে যেন।
তারি 'পরে ভাসে তরণী হিরণ,
তারি 'পরে পড়ে সন্ধ্যাকিরণ,
তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি
হাসিছ কেন?
আমি তো বুঝি না কী লাগি তোমার
বিলাস হেন।
যখন প্রথম ডেকেছিলে তুমি
"কে যাবে সাথে'
চাহিনু বারেক তোমার নয়নে
নবীন প্রাতে।
দেখালে সমুখে প্রসারিয়া কর
পশ্চিম-পানে অসীম সাগর,
চঞ্চল আলো আশার মতন
কাঁপিছে জলে।
তরীতে উঠিয়া শুধানু তখন
আছে কি হোথায় নবীন জীবন,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায়
সোনার ফলে?
মুখপানে চেয়ে হাসিলে কেবল
কথা না ব'লে।
তার পরে কভু উঠিয়াছে মেঘ
কখনো রবি--
কখনো ক্ষুব্ধ সাগর, কখনো
শান্ত ছবি।
বেলা বহে যায়, পালে লাগে বায়--
সোনার তরণী কোথা চলে যায়,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন
অস্তাচলে।
এখন বারেক শুধাই তোমায়,
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হোথায়,
আছে কি শান্তি, আছে কি সুপ্তি
তিমির-তলে?
হাসিতেছ তুমি তুলিয়া নয়ন
কথা না ব'লে।
আঁধার রজনী আসিবে এখনি
মেলিয়া পাখা,
সন্ধ্যা-আকাশে স্বর্ণ-আলোক
পড়িবে ঢাকা।
শুধু ভাসে তব দেহসৌরভ,
শুধু কানে আসে জল-কলরব,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব
কেশের রাশি।
বিকল হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর,
"কোথা আছ ওগো করহ পরশ
নিকটে আসি।'
কহিবে না কথা, দেখিতে পাব না
নীরব হাসি।
.
২৭ অগ্রহায়ণ ১৩০০
কাগজের নৌকা - ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে কাগজ নৌকাখানি
কাগজের নৌকা
.
ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে
কাগজ-নৌকাখানি।
লিখে রাখি তাতে আপনার নাম,
লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম
বড়ো বড়ো ক'রে মোটা অক্ষরে
যতনে লাইন টানি।
যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে
আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে
আমার লিখন পড়িয়া তখন
বুঝিবে সে অনুমানি
কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে
কাগজ-নৌকাখানি ।।
আমার নৌকা সাজাই যতনে
শিউলি বকুলে ভরি।
বাড়ির বাগানে গাছের তলায়
ছেয়ে থাকে ফুল সকাল বেলায়,
শিশিরের জল করে ঝলমল্
প্রভাতের আলো পড়ি।
সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা
কোন্ দিক-পানে চলে যায় সোজা,
বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী
ঠেকে কোনোখানে যেয়ে -
প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল
কাগজের তরী বেয়ে ।।
আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে
চেয়ে থাকি বসি তীরে।
ছোটো ছোটো ঢেউ উঠে আর পড়ে,
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে,
আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি,
বায়ু বহে ধীরে ধীরে ।
গগনের তলে মেঘ ভাসে কত
আমারি সে ছোটো নৌকার মতো -
কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়,
কোন দেশে গিয়ে লাগে।
ঐ মেঘ আর তরণী আমার
কে যাবে কাহার আগে ।।
বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে
নিয়ে যায় মোরে টানি
আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোনে মিশি,
যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি,
কোথা কোন্ গাঁয় ভেসে চলে যায়
আমার নৌকাখানি ।
কোন্ পথে যাবে কিছু নাই জানা,
কেহ তারে কভু নাহি করে মানা,
ধ'রে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে -
ধায় নব নব দেশে।
কাগজের তরী, তারি 'পরে চড়ি
মন যায় ভেসে ভেসে ।।
রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়,
মুখ ঢাকি দুই হাতে -
চোখ বুঁজে ভাবি এমন আঁধার,
কালী দিয়ে ঢালা নদীর দুধার -
তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে
নৌকা চলেছে রাতে।
আকাশের তারা মিটি মিটি করে,
শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে,
তরীখানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি
তীরে তীরে ফিরে ভাসি।
ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে
ঘুম-পাড়ানিয়া মাসি ।।
26 November, 2015
ঘরেতে ভ্রমর এল
ঘরেতে ভ্রমর এল গুন্গুনিয়ে।
আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥
আলোতে কোন্ গগনে মাধবী জাগল বনে,
এল সেই ফুল-জাগানোর খবর নিয়ে।
সারাদিন সেই কথা সে যায় শুনিয়ে।
কেমনে রহি ঘরে, মন যে কেমন করে,
কেমনে কাটে যে দিন দিন গুনিয়ে।
কী মায়া দেয় বুলায়ে, দিল সব কাজ ভুলায়ে,
বেলা যায় গানের সুরে জাল বুনিয়ে।
আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে॥
তোমার খোলা হাওয়া
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে
টুকরো ক'রে কাছি
ডুবতে রাজি আছি
আমি ডুবতে রাজি আছি।
সকাল আমার গেল মিছে,
বিকেল যে যায় তারি পিছে;
রেখো না আর, বেঁধো না আর
কূলের কাছাকাছি।
মাঝির লাগি আছি জাগি
সকল রাত্রিবেলা,
ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে
করে কেবল খেলা।
ঝড়কে আমি করব মিতে,
ডরব না তার ভ্রূকুটিতে;
দাও ছেড়ে দাও ওগো, আমি
তুফান পেলে বাঁচি।
এসো আমার ঘরে
এসো আমার ঘরে।
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে॥
স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে
মুগ্ধ এ চোখে।
ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে এসে আমার ঘরে॥
দুঃখসুখের দোলে এসো,
প্রাণের হিল্লোলে এসো।
ছিলে আশার অরূপ বাণী ফাগুনবাতাসে
বনের আকুল নিশ্বাসে--
এবার ফুলের প্রফুল্ল রূপ এসো বুকের 'পরে॥
24 November, 2015
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম॥
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম॥
জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।
মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম॥
23 November, 2015
মোর বীণা ওঠে কোন্ সুরে বাজি
মোর বীণা ওঠে কোন্ সুরে বাজি
কোন্ নব চঞ্চল ছন্দে।
মম অন্তর কম্পিত আজি নিখিলের হৃদয়স্পন্দে॥
আসে কোন্ তরুণ অশান্ত, উড়ে
বসনাঞ্চলপ্রান্ত,
আলোকের নৃত্যে বনান্ত মুখরিত
অধীর আনন্দে।
অম্বরপ্রাঙ্গনমাঝে নিঃস্বর মঞ্জীর গুঞ্জে।
অশ্রুত সেই তালে বাজে করতালি
পল্লবপুঞ্জে।
কার পদপরশন-আশা তৃণে তৃণে
অর্পিল ভাষা,
সমীরণ বন্ধনহারা উন্মন কোন্ বনগন্ধে॥
তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল
তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল
বীণাবাদিনীর শতদলদলে করিছে সে টলোমল।
মোর গানে গানে পলকে পলকে ঝলসি উঠিছে ঝলকে
ঝলকে,
শান্ত হাসির করুণ আলোকে ভাতিছে নয়নপাতে॥
21 November, 2015
মোর বীণা ওঠে কোন্ সুরে বাজি
মোর বীণা ওঠে কোন্ সুরে বাজি
কোন্ নব চঞ্চল ছন্দে।
মম অন্তর কম্পিত আজি নিখিলের হৃদয়স্পন্দে॥
আসে কোন্ তরুণ অশান্ত,
উড়ে বসনাঞ্চলপ্রান্ত,
আলোকের নৃত্যে বনান্ত মুখরিত অধীর আনন্দে।
অম্বরপ্রাঙ্গনমাঝে নিঃস্বর মঞ্জীর গুঞ্জে।
অশ্রুত সেই তালে বাজে করতালি পল্লবপুঞ্জে।
কার পদপরশন-আশা তৃণে তৃণে অর্পিল ভাষা,
সমীরণ বন্ধনহারা উন্মন কোন্ বনগন্ধে॥
16 November, 2015
বঁধু কোন্ আলো লাগল চোখে
বঁধু, কোন্ আলো লাগল চোখে!
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে!
ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করিযুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে,
জন্ম-জনম গেল বিরহশোকে।
অস্ফুটমঞ্জরী কুঞ্জবনে,সংগীতশূন্য বিষণ্ন মনেসঙ্গীরিক্ত চিরদুঃখরাতিপোহাব কি নির্জনে শয়ন পাতি!
সুন্দর হে, সুন্দর হে,বরমাল্যখানি তব
আনো বহে,অবগুণ্ঠনছায়া ঘুচায়ে দিয়েহেরো লজ্জিত স্মিতমুখশুভ আলোকে॥
সখী ভাবনা কাহারে বলে
সখী, ভাবনা কাহারে বলে।
সখী, যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলই যাতনাময় ।
সে কি কেবলই চোখের জল?
সে কি কেবলই দুখের শ্বাস ?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে
এমন দুখের আশ ।
আমার চোখে তো সকলই শোভন,
সকলই নবীন, সকলই বিমল, সুনীল
আকাশ, শ্যামল কানন,বিশদ জোছনা,
কুসুম কোমল— সকলই আমার মতো ।তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়,
হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—
না জানে বেদন, না জানে রোদন,
না জানে সাধের যাতনা যত ।
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে,
জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায় ।
আমার মতন সুখী কে আছে।
আয় সখী, আয় আমার কাছে—
সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা—
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা।
ভালোবেসে যদি সুখ নাহিতবে কেন তবে কেন
ভালোবেসে যদি সুখ নাহিতবে কেন,
তবে কেন মিছে ভালোবাসা।
মন দিয়ে মন পেতে চাহি।
ওগো কেন,ওগো কেন মিছে এ দুরাশা।
হৃদয়ে জ্বালায়ে বাসনার শিখা,নয়নে
সাজায়ে মায়া-মরীচিকা,শুধু ঘুরে মরি মরুভূমে।
ওগো কেন,ওগো কেন মিছে এ পিপাসা।
আপনি যে আছে আপনার কাছে,নিখিল
জগতে কী অভাব আছে।
আছে মন্দ সমীরণ, পুষ্পবিভূষণ,
কোকিল-কূজিত কুঞ্জ।
বিশ্বচরাচর লুপ্ত হয়ে যায়,
এ কী ঘোর প্রেম অন্ধ রাহুপ্রায়জীবন যৌবন গ্রাসে।
তবে কেন,তবে কেন মিছে এ কুয়াশা।
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে,
বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে,
কী ছিল বিধাতার মনে।
বনের পাখি বলে, ‘খাঁচার পাখি ভাই, বনেতে যাই দোঁহে মিলে।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘বনের পাখি আয়,
খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।’
বনের পাখি বলে, ‘না, আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, আমি কেমনে বনে
বাহিরিব।’
বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি বনের গান ছিল যত,
খাঁচার পাখি গাহে শিখানো বুলি তার— দোঁহার ভাষা দুইমত।
বনের পাখি বলে ‘খাঁচার পাখি ভাই,
বনের গান গাও দেখি।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘বনের পাখি ভাই,
খাঁচার গান লহো শিখি।’
বনের পাখি বলে, ‘না, আমি শিখানো গান
নাহি চাই।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায় আমি কেমনে বনগান গাই।’
বনের পাখি বলে, ‘আকাশ ঘন নীল কোথাও বাধা নাহি তার।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘খাঁচাটি পরিপাটি কেমন
ঢাকা চারিধার।’
বনের পাখি বলে, ‘আপনা ছাড়ি দাও মেঘের মাঝে একেবারে।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘নিরালা কোণে বসে বাঁধিয়া রাখো আপনারে।’
বনের পাখি বলে, ‘না, সেথা কোথায় উড়িবারে পাই !’
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, মেঘে কোথায় বসিবার ঠাঁই।’
এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে,
তবুও কাছে নাহি পায়।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে, নীরবে চোখে চোখে চায়।
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে, বুঝাতে নারে আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা—কাতরে কহে, ‘কাছে আয় !’
বনের পাখি বলে, ‘না, কবে খাঁচায় রুধি দিবে দ্বার !’
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, মোর শকতি নাহি
উড়িবার।’
08 November, 2015
সখী ভাবনা কাহারে বলে সখী যাতনা কাহারে বলে
সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী,
যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’
‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি
কেবলই যাতনাময় ।
সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি
কেবলই দুখের শ্বাস ?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে
এমন দুখের আশ ।
আমার চোখে তো সকলই শোভন,
সকলই নবীন, সকলই বিমল,
সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,
বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল—
সকলই আমার মতো ।
তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া
খেলিয়া মরিতে চায়—
না জানে বেদন, না জানে রোদন, না জানে
সাধের যাতনা যত ।
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা
হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের
তারা তেয়াগে কায় ।
আমার মতন সুখী কে আছে।
আয় সখী, আয় আমার কাছে—
সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের
জুড়াবে প্রাণ ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয়
হাসিবি তোরা—
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া
গাহিব মোরা।।
.
রাগ: বেহাগ-খাম্বাজ-বাউল
তাল: একতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1287
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1881
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়,
তুমি তাই, তুমি তাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর, কেহ নাই কিছু নাই গো।
তুমি সুখ যদি নাহি পাও,
যাও, সুখের সন্ধানে যাও,
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে,
আর কিছু নাহি চাই গো।
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী,
দীর্ঘ বরষ মাস।
যদি আর কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে, তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও,
আমি যত দুখ পাই গো।
.
রাগ: পিলু
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): অগ্রহায়ণ, ১২৯৫
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1888
রচনাস্থান: কলকাতা, দার্জিলিং
স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী,
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
দুজনে দেখা হল মধুযামিনী রে
দুজনে দেখা হল মধুযামিনী রে--
কেন কথা কহিল না, চলিয়া গেল ধীরে॥
নিকুঞ্জে দখিনাবায় করিছে হায়-হায়,
লতাপাতা দুলে দুলে ডাকিছে ফিরে ফিরে॥
দুজনের আঁখিবারি গোপনে গেল বয়ে,
দুজনের প্রাণের কথা প্রাণেতে গেল রয়ে।
আর তো হল না দেখা, জগতে দোঁহে একা--
চিরদিন ছাড়াছাড়ি যমুনাতীরে॥